হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, পর্ব ৩- ইমামের নির্দেশে ইসলামী মুদ্রার প্রচলন ২২
হিজরী শতাব্দীর প্রথম দিকে কাগজ শিল্প রোমানদের হাতে ছিল। মিশরের খৃস্টানরাও রোমানদের নীতিকৌশল অবলম্বন করেই কাগজ তৈরী করত। আর তাতে খৃস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী ত্রিত্ববাদ ইঙ্গিতকারী বিশেষ চিহ্ন সংযোজন করত। উমাইয়্যা শাসক আবদুল মালেক ছিল অতি চালাক প্রকৃতির। এই ধরনের কাগজ দেখে তার উপর সংযোজনকৃত চিহ্নটির ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য নির্দেশ দিল। যখন তার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারল অত্যন্ত রাগান্বিত হল। এ কারণে যে মিশর একটি ইসলামী রাষ্ট্র। আর এ রাষ্ট্রে ব্যবহৃত শিল্পজাতদ্রব্যে এ ধরনের প্রতীক থাকবে এটা হতে পারে না। সাথে সাথে মিশরের গভর্ণরকে নির্দেশ দিল যে এ ধরনের কাগজগুলিকে নষ্ট করে তার স্থানে তৌহিদের শ্লোগান شَهِدَ اللَّه اَنَّهُ لاَ اِلَهَ الاَّ هُو. সম্বলিত কাগজ তৈরি করতে। আর পার্শ্ববর্তী সব ইসলামী প্রদেশগুলিকেও খৃস্টানদের অংশীবাদী বিশ্বাসের প্রতীক সম্বলিত কাগজ নষ্ট করে ফেলে নতুন কাগজ ব্যবহারের জন্য নির্দেশ পাঠাতে বলল।
তৌহিদী উক্তি সম্বলিত কাগজের ব্যবহার বেশ প্রচার পেল। সেই কাগজ রোমের বিভিন্ন শহরেও পৌঁছাল। এই খবর রোমের সম্রাটের কাছে পৌঁছালে সে আবদুল মালেকের কাছে এ মর্মে একটি চিঠি পাঠাল : কাগজের মুদ্রা সর্বদা খৃস্টানদের প্রতীক সম্বলিত ছিল। তা পাল্টানোর সিদ্ধান্ত যদি তোমার হয়ে থাকে,তাহলে তোমার আগের খলিফারা ভুল করেছে। আর যদি তারা ঠিক করে থাকে তাহলে তুমি ভুল করছো।২৩ আমি এই চিঠির সাথে তোমার জন্য উপযুক্ত উপঢৌকন পাঠালাম যেন তাতে তুমি সন্তুষ্ট হও। আর প্রতীক সম্বলিত কাগজের প্রচলন যেন আগের মতই থাকে। জবাব হ্যাঁ সূচক হলে তোমার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা থাকবে। আবদুল মালেক উপঢৌকন সামগ্রী গ্রহণ করল না এবং রোমের সম্রাটের বিশেষ দূতকে বলল : এই চিঠির কোন উত্তর নেই।
আবদুল মালেকের কাছে রোমের বাদশার পক্ষ থেকে দ্বিতীয়বারের মত দ্বিগুণ পরিমান উপঢৌকন প্রেরিত হলো। তার সাথে আরও একটি চিঠি পাঠাল : আমার মনে হয় উপঢৌকন সামগ্রী অল্প হওয়াতে তুমি গ্রহণ করনি। এখন দিগুণ পরিমানে পাঠালাম আশা করব যে এই উপঢৌকনের কারণে তোমার কাছে আমার আগের চাওয়া বিষয়টিও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। আবদুল মালেক প্রথমবারের ন্যায় এবারও উপহার সামগ্রী গ্রহণ করল না এবং চিঠির জবাবও দিল না।
রোমের সম্রাটের পক্ষ থেকে আবার আবদুল মালেকের কাছে চিঠি আসল : দুইবার আমার পাঠানো উপহার গ্রহণ করলে না। আমার ইচ্ছাও পূর্ণ করলে না। তৃতীয়বারের মত কয়েকগুণ বেশি উপঢৌকন পাঠালাম। ঈসার কসম যদি প্রতীক সম্বলিত কাগজের ব্যবহার আগের পর্যায়ে ফিরিয়ে না আন তাহলে নবী মুহাম্মদের নামের সাথে অপমানকর বাক্য সম্বলিত স্বর্ণ ও রোপ্য মুদ্রা তৈরী করার নির্দেশ দেব। আর তুমি তো এটা ভাল করেই জান যে রোমানরা মুদ্রা তৈরীতে বিশেষ পারদর্শী। যখন তোমরা তোমাদের নবীর নামে অপমানকর বাক্য সম্বলিত মুদ্রাগুলি দেখবে তখন লজ্জায় তোমাদের কপাল ঘামে ভিজে যাবে। সুতরাং এটাই ভাল যে উপঢৌকনগুলি গ্রহণ করে আমাদের ইচ্ছাটিকে পূরণ কর। যেন আমাদের অতীতের বন্ধুত্ব আগের মতই থাকে।
আবদুল মালেক তার চিঠির জবাবে উপায়হীন হয়ে বলল আমার ধারণা এটাই যে,মুসলমানদের মধ্যে যদি কোন নিকৃষ্ট ব্যক্তি জন্ম গ্রহণ করে থাকে আমিই সেই ব্যক্তি। কেননা আমিই এই কাজের কারণ হয়েছি যে রাসূল (সা.)-কে অবমাননা করবে। মুসলমানদের সাথে আলোচনা করল কিন্তু কেউ কোন উপায় বের করতে পারল না। তাদের একজন বলল : তুমি নিজেও এর উপায় জান কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে সে উপায়কে গ্রহণ করছো না।
আবদুল মালেক : এই হতভাগা,তুমি বলছো আমি সে উপায়টি জানি। কিন্তু সেটা কি?
বলল : নবী পরিবারের বাকেরের কাছ থেকে থেকে এই সমস্যার সমাধান চাও,অবশ্যই তিনি এর সমাধান দিতে পারবেন।
আবদুল মালেক তার কথাকে মেনে নিল। ইমাম বাকের (আ.)-কে অত্যন্ত সম্মানের সাথে সিরিয়ায় পাঠানোর জন্য মদীনার গভর্ণরকে নির্দেশ পাঠাল। রোমের সম্রাটের পাঠানো বিশেষ দূতকে ইমাম আসা পর্যন্ত সেখানেই রেখে দিল। ইমাম শামে(সিরিয়ায়) এলে তার কাছে ঘটনার বর্ণনা দিলে তিনি বললেন :
নবী (সা.)-এর অবমাননার ব্যাপারে রোমের সম্রাটের পক্ষ থেকে যে হুমকি এসেছে তা বাস্তবায়িত হবে না। কেননা আল্লাহ্ এই কাজ তাকে করতে দিবেন না। আর এই সমস্যার সমাধানের পথও অত্যন্ত সহজ। এখন সমস্ত শিল্পীদেরকে এক জায়গায় একত্রিত কর যেন তারা মুদ্রা তৈরীর কাজে লাগতে পারে। মুদ্রার এক পিঠে সূরা ইখলাছ ও অন্য পিঠে নবী (সা.)-এর নাম লেখ। আর এভাবেই আমরা রোমানদের ধাতবমুদ্রা থেকে অমুখাপেক্ষী হবো। মুদ্রার ওজন সম্পর্কেও তিনি এভাবে ব্যাখ্যা দেন যে,দশ দেরহাম করে তিন ধরনের মুদ্রা তৈরী করবে যার প্রতিটির ওজন হবে সাত মিসকাল।২৪ তিনি আরও বললেন,যে শহর থেকে মুদ্রা তৈরী করা হবে সে শহরের নাম,তারিখ ও বছর যেন তাতে উল্লেখ করা হয়।
আবদুল মালেক ইমামের নির্দেশকে বাস্তবায়ন করল এবং প্রতিটি ইসলামী প্রদেশগুলিতে সংবাদ পাঠাল যে সব ধরনের বেচা-কেনাতে যেন নতুন মুদ্রা ব্যবহার করা হয়। এখনও যাদের কাছে আগের মুদ্রা আছে ফেরত দিয়ে তাদেরকে ইসলামী মুদ্রা গ্রহণ করার জন্য জানাল। আর সম্রাটের বিশেষ দূতকে এ বিষয়ে অবগত করে পাঠিয়ে দিল।
সম্রাটকে এই ঘটনা সম্বন্ধে অবগত করা হলো। দরবারের লোকেরা তাকে আবদুল মালেককে দেয়া অতীতের হুমকিকে কার্যে পরিণত করার জন্য অনুরোধ জানালে সে বলল : আমি শুধুমাত্র তাকে রাগাতে চেয়েছিলাম মাত্র। কিন্তু এ কাজ এখন অনর্থক কেননা ইসলামী দেশগুলিতে এখন আর রোমান মুদ্রার ব্যবহার হবে না।২৫
ইমামের সাহাবাগণ
ইমাম আবু জা’ফর বাকেরুল উলুমের শিক্ষালয়ে যে সকল উন্নত ও উপযুক্ত ছাত্র তৈরী হয়েছিল এখানে তাদের কয়েক জনের ব্যক্তিত্ব তুলে ধরা হলো :
১.আবান বিন তাগলিব : তিনি তিন ইমামের সংর্স্পশ লাভে ধন্য হয়েছেন- ইমাম যয়নুল আবেদীন,ইমাম মুহাম্মদ বাকের ও ইমাম জা’ফর সাদেক (আ.)। তিনি তার যুগের একজন জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচিত ছিলেন। কেননা তিনি তাফসীর,হাদীস,ফিকাহ্ শাস্ত্র,কেরাআত (পঠন শাস্ত্র) ও আভিধানিক জ্ঞানে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তার জ্ঞানের এতটা গভীরতা ছিল যে ইমাম বাকের (আ:)তাকে মদীনার মসজিদে বসে মানুষের উদ্দেশ্যে ফতোয়া দিতে বলেছিলেন। তিনি বলেন : আমি পছন্দ করি যে মানুষ তোমার মত আমাদের অনুসারীদেরকে দেখুক বা চিনুক।
আবান যখনই মদীনায় আসতেন অন্যান্য জ্ঞানের আসরগুলি ভেঙ্গে যেত। আর মসজিদে যেখানে নবী (সা.) খোৎবা দিতেন সে স্থানটি অন্যরা তার শিক্ষাদনের জন্য খালি করে দিত।
আবানের মৃত্যুর সংবাদ ইমাম সাদেক (আ.)-এর কাছে পৌঁছালে তিনি বললেন : আল্লাহর কসম! আবানের মৃত্যুর সংবাদে আমার হৃদয়ে ব্যথা শুরু হয়েছে।২৬
২.যুরারাহ্ : ইমাম বাকের ও ইমাম সাদিক (আ.)-এর মাধ্যমে প্রশিক্ষিত শিয়া মনীষীদের মধ্যে ছয়জনকে বিশেষ মর্যাদার মনে করা হয়। যুরারাহ্ তাদের মধ্যে একজন। ইমাম সাদেক (আ:)নিজে বলেছেন : যদি বোরাইদ বিন মুয়াবিয়া,আবু বাসির,মুহাম্মদ বিন মুসলিম ও যুরারাহ্ না থাকত তাহলে নবী (সা.)-এর নিদর্শন (শিয়াদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা) সব শেষ হয়ে যেত। তারা আল্লাহর হারাম-হালালের ব্যাখ্যায় বিশ্বস্ত।
আরও বলেন : বোরাইদ,যুরারাহ্,মুসলিম ও আহওয়াল জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থায় আমার অতি প্রিয়ভাজন ব্যক্তিত্ব।
ইমামের প্রতি যুরারার ভালবাসা এতই গভীর ছিল যে ইমাম সাদেক (আ:)তার জীবন বাঁচানোর জন্য উপায়হীন হয়ে তার ব্যাপারে মন্দ বলা ও তার সাথে কৃত্রিম ব্যবহার করা শুরু করলেন। কিন্তু গোপনে তাকে খবর দিলেন যে,তোমার ব্যাপারে মন্দ বলছি এ জন্য যে তোমার প্রতি বিশ্বাস রাখি। কেননা শত্রুরা আমাদের প্রতি অন্যদের ভালবাসার কথা জানতে পারলে তাকে নানাভাবে অত্যাচার করবে। আর আমাদের ভালবাসাকে প্রকাশ করার ব্যাপারে তোমার প্রসিদ্ধি আছে। এ কারণে আমার পক্ষে এরূপ কৃত্রিম ব্যবহার করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। যুরারাহ্ কেরাআত,ফিকাহ্,কালাম শাস্ত্র,কবিতা ও আরবী সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন এবং তার মর্যাদা ও দীনদারী সম্পর্কে সকলেই জানত।২৭
৩.কুমায়েত আসাদী : তিনি একজন প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন। স্পষ্ট ভাষার মাধ্যমে আহলে বাইতের পক্ষে গভীর অর্থ সম্বলিত কবিতা রচনা করতেন। তার কবিতা উমাইয়্যা শাসকদের বিরুদ্ধে এমন মারাত্মক ও অপমানজনক ছিল যার কারণে উমাইয়্যা খলিফার পক্ষ থেকে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়।
সত্য বর্ণনা করা এবং নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের পক্ষে কথা বলা ঐ যুগে এত দুরূহ ব্যাপার ছিল যে অত্যন্ত সাহসী ও প্রভাবশালী লোকও এ ধরনের কাজে সাহস পেত না। কুমায়েত এমন এক সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি যে উমাইয়্যা খেলাফতের সময় মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে তার শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী সত্য বর্ণনা করত। মানুষের সামনে উমাইয়্যা খেলাফতের স্বরূপ উন্মোচন করত।
কুমায়েত তার কিছু কবিতায় ইমামগণকে বনি উমাইয়্যাদের বিপক্ষে এমনভাবে পরিচয় করিয়েছে : এই ন্যায়পরায়ণ পথ পরিচালক বা নেতাগণ বনি উমাইয়্যাদের মত নন যে মানুষ ও পশুদেরকে একই রকম মনে করবে। তাঁরা আবদুল মালেক,ওয়ালিদ, সোলাইমান ও হিশামের মত নন যে মিম্বারে বসে এমন কথা বলেন না যা তা নিজেরা করেন না। উমাইয়্যারা তাদের বক্তব্যে নবীর কথা বলে কিন্তু নিজেরা জাহেলিয়াতের যুগের ন্যায় কাজ করে থাকে।২৮
কুমায়েত ইমাম বাকের (আ.)-এর অত্যন্ত ভক্ত ছিলেন। আর এই ভালবাসার পথে নিজেকে ভুলে গিয়েছিলেন। একদিন ইমামের সামনে তাঁকে নিয়ে রচিত একটি কবিতা পাঠ করল। ইমাম কা’বার দিকে ফিরে তিনবার বললেন : ইয়া আল্লাহ্! তুমি কুমায়েতের প্রতি করুণা কর। আর কুমায়েতকে বললেন তোমার জন্য আমরা পরিবারের সবাই মিলে একশ দেরহাম জমা করেছি।
কুমায়েত : আল্লাহর কসম! কখনও স্বর্ণ ও রৌপ্য চাইনা। শুধুমাত্র আপনার একটি জামা আমাকে দিন। ইমাম তাঁর গায়ের জামাটি খুলে তাকে দিলেন।২৯
অন্য আরেকদিন তিনি ইমামের পাশে বসে ছিল। ইমাম তাঁর যুগের করুণ অবস্থা বর্ণনা করে এই কবিতাটি বললেন :
ذَهَبَ الَّذِينَ يُعاَشُ فِى اَكْناَفِهِمْ لَمْ يَبْقَ اِلاَّ شاَتِمٌ اَوْحَاسِدٌ
অর্থাৎ যারা উদার প্রাণ ব্যক্তি ছিল,যাদের আশ্রয়ে মানুষ জীবন যাপন করত,তারা সবাই চলে গেছে,শুধুমাত্র হিংসুক আর নষ্টরা ছাড়া কেউ নেই।
কুমায়েত সাথে সাথে জবাব দিলেন :
وَبَقىَ عَلىَ ظَهْرِ الْبَسِيطَةِ واحِدٌ فَهُوَا الْمُرادُ وَ اَنْتَ ذاكَ الْواحِدُ
কিন্তু এই দুনিয়ায় একজন মহামানব আছেন যাকে দুনিয়ার সবাই জানে আর সে ব্যক্তি হচ্ছেন আপনি।৩০
৪.মুহাম্মদ বিন মুসলিম : তিনি ফকীহ্৩১ এবং ইমাম বাকের ও ইমাম সাদেক (আ.)-এর সহচারী ছিলেন। যেমনটি পূর্বে উল্লেখ করেছি ইমাম সাদেক (আ:)তাকে ঐ চার জনের মধ্যে একজন হিসাব করতেন যাদের কারণে নবী (সা.)-এর নিদর্শন টিকে আছে।
তিনি ছিলেন কুফাবাসী। ইমাম বাকের (আ.)-এর সীমাহীন জ্ঞান থেকে নিজের জ্ঞান বিকাশের লক্ষ্যে মদীনায় আসেন এবং চার বছর মদীনায় থাকেন।
আবদুল্লাহ্ বিন আবি ইয়া’ফুর বলেন : ইমাম সাদেক (আ.)-এর কাছে বলেছিলাম যে,কেউ কেউ কখনও আমার কাছে প্রশ্ন করে যার উত্তর আমি জানি না। আর আপনাকেও সে সময় পাই না। এমতাবস্থায় আমি কি করব?
ইমাম,মুহাম্মদ বিন মুসলিমকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন : কেন তার কাছ থেকে তোমার অজানা জবাবগুলি জেনে নাও না ।৩২
কুফায় একরাতে এক মহিলা মুহাম্মদ বিন মুসলিমের বাসায় এসে বলল : আমার ছেলের স্ত্রী,গর্ভে বাচ্চা নিয়ে মারা গেছে এবং যে বাচ্চা তার গর্ভে আছে সে জীবিত,আমাদের এখন কি করণীয়?
মুহাম্মদ : যেভাবে ইমাম বাকের (আ:)বলেছেন সে অনুযায়ী তার পেট কেটে বাচ্চাকে বাইরে এনে তারপর তাকে মাটি দিতে হবে। অতঃপর ঐ মহিলাকে জিজ্ঞেস করল যে,সে তাকে কিভাবে চিনে?
মহিলা : এই বিষয়টিকে ‘আবু হানিফার’ কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বলল এই বিষয়ে আমি কিছু জানিনা। আর আমাকে আপনার কাছে আসার পরামর্শ দিল। এও বলল যদি আপনি এ ব্যাপারে কোন ফতোয়া দেন তাহলে আমি যেন তাকে জানাই.।
অন্য আরেকদিন মুহাম্মদ বিন মুসলিম কুফার মসজিদে আবু হানিফাকে দেখলো যে কিছু ব্যক্তির মধ্যে সে ঐ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে। ঐ সমস্যার সমাধানটি নিজে দিয়েছে এমনটিই বোঝাতে চাইলো তাদেরকে। মুহাম্মদ আস্তে করে কাশি দিল। ওদিকে আবু হানিফা বুঝতে পেরে বলল,‘আল্লাহ্ তোমাকে ক্ষমা করুন আমাকে জীবন যাপন করতে দাও।’৩৩
ইমামের শাহাদাত
মহান ইমাম বাকেরুল উলুম ৫৭ বছর বয়সে ১১৪ হিজরী যিলহজ মাসের ৭ তারিখে অত্যাচারী উমাইয়্যা শাসক আবদুল মালেকের শাসনামলে বিষ প্রয়োগে শহীদ হন। শাহাদাতের দিন সন্ধ্যায় ইমাম সাদেক (আ.)-কে বললেন : আমি আজ রাতে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাব। এখনই আমি (স্বপ্নে) দেখতে পেলাম আমার বাবা আমার কাছে শরবত নিয়ে আসলেন,আর আমি তা পান করলাম।তিনি আমাকে চিরন্তন আশ্রয়ে যাওয়ার ও আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভের সুসংবাদ দিলেন।
পরদিন আল্লাহ্ প্রদত্ত সীমাহীন জ্ঞানের এই পবিত্র ব্যক্তিটিকে বাকি নামক কবরস্থানে ইমাম হাসান মুজতাবা ও ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর সমাধিস্থানের পাশে দাফন করা হলো। তাঁর উপর আল্লাহর সালাম বর্ষিত হোক।৩৪
এখন এই শেষ পর্যায়ে এই মহামানবের জ্ঞানের সমুদ্র থেকে শিক্ষণীয় কিছু বিষয় তুলে ধরব :
মিথ্যাকে পরিহার করাই ঈমান।৩৫
মুমিন ব্যক্তি ভীতু,লোভী বা কৃপণ হয় না।৩৬
দুনিয়ার প্রতি লোভ রেশম পোকার গুটির ন্যায়,যতই তার উপর সুতার আবরণ তৈরী করবে ততই তা থেকে তার বেরিয়ে আসা অতিশয় কষ্টকর হবে।৩৭
মুমিনদের তিরস্কার করা থেকে দূরে থেকো।৩৮
তোমার মুসলমান ভাইদেরকে ভালবাসবে এবং যা কিছু নিজের জন্য চাও তা তাদের জন্যও চাইবে আর যা কিছু নিজের জন্য পছন্দ কর না তা তাদের জন্যও পছন্দ করবে না।৩৯
যদি এক মুসলমান অন্য এক মুসলমানের বাড়ীতে কোন কিছু চাইতে বা তার সাথে দেখা করতে যায়,আর সে বাড়ীতে থাকে কিন্তু তাকে ঢোকার অনুমতি না দেয় এবং নিজে তার সাথে দেখা করতে না যায়,এই বাড়ীর কর্তার উপর আল্লাহর গজব পড়তে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা একে অপরের সাথে মিলিত হয় ।৪০
আল্লাহ্ তায়ালা লজ্জা ও সহনশীলতাকে পছন্দ করেন।৪১
যারা মানুষের প্রতি রাগকে ভুলে যায় আল্লাহ্ তার থেকে কিয়ামতের আজাবকে তুলে নেন।৪২
যারা ভাল কাজে উপদেশ দান ও খারাপ কাজে বাধা দান করাকে ত্রুটি বলে মনে করে তারা খারাপ লোক।৪৩
কোন বাড়ীতে শত্রু প্রবেশ করলে ঐ বাড়ীর কর্তা যদি সেই শত্রুর সাথে মুকাবিলা না করে তবে সেই বান্দার সাথে আল্লাহ্ শত্রুতা পোষণ করেন।৪৪
তথ্যসূত্র :
১। মেসবাহুল মোতাহাজ্জেদ, শেখ তুসি, পৃ. ৫৫৭ ।
২।ইমাম সাদেক (আ:)উম্মে আবদুল্লাহ্র ব্যাপারে বলেছেন : তিনি একজন ঈমানদার, পরহেজগার ও সতী-সাধ্বী নারী ছিলেন... তাওয়ারিখুন্নাবী, তুসতারী, পৃ. ৪৭ ।
৩। আমালি, শেখ সাদুক, পৃ. ২১১।
৪। ইলালুশ শারায়ে, শেখ সাদুক, পৃ. ২২২ ।
৫। এরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ২৪৬ ।
৬। প্রাগুক্ত
৭। মানাকেব, ইবনে শাহ্রে আশুব, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩২৯ ।
৮। বিহারুল আনওয়ার, ৪৬তম খণ্ড, পৃ. ২৪৩ ।
৯। বিহারুল আনওয়ার, ৪৬তম খণ্ড, পৃ. ২৪৩ ।
১০। প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৭ ।
১১। আমালি, শেখ তুসি, পৃ. ২৬১ ।
১২। ইরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ২৪৭ ।
১৩। সূরা মায়েদা, আয়াত : ৩ ।
১৪। সূরা আল কিয়ামাহ্ : ১৬ ।
১৫। সূরা আল হাক্কাহ্ : ১২ ।
১৬। সূরা নাহল : ৮৯।
১৭। সূরা ইয়াসীন : ১২।
১৮। সূরা আনআম : ৩৮।
১৯। দালায়েলুল ইমামাহ্ ,তাবারি, পৃ. ১০৪-১০৬।
২০। সূরা বাকারা : ১৮৭।
২১। সূরা আনআম : ১২৪, ও কাফি, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৯।
২২। বিস্তারিত জানার জন্য আল আকদুল মুনির, খণ্ড - ১।
২৩। রোম সম্রাট তার কথার মাধ্যমে আবদুল মালেকের পূর্ববর্তী খলিফাদের প্রতি গোঁড়ামীকে উস্কে দিতে চাইলো, এ জন্য যে রোমের কাগজের ব্যবহার পূর্বে প্রচলিত থাকলেও অতীত খলিফাদের কোনরূপ আপত্তি ছিলনা।
২৪। ইমাম বাকের (আ:)বলেন : তিন ধরনের মুদ্রা তৈরী হবে, প্রথমটি প্রতি এক দেরহাম এক মেসকাল এবং এভাবে দশ দেরহাম দশ মেসকাল, দ্বিতীয়টি প্রতি দশ দেরহাম ছয় মেসকাল এবং তৃতীয়টি প্রতি দশ দেরহাম পাঁচ মেসকাল হবে। আর এভাবে ঐ তিন ধরনের মুদ্রা হতে প্রতি ত্রিশ দেরহামে একুশ মেসকাল হতো। এটা রোমের মুদ্রার সমমান ছিল। মুসলমানরা বাধ্য ছিল যে রোমানদের ত্রিশ দেরহাম যা একুশ মেসকাল হতো তা ফেরত দিয়ে নতুন ত্রিশ দেরহাম নেওয়ার জন্য।
২৫। আল মাহাসেন ওয়াল মাসাভী, বাইহাকি, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩২-২৩৬, মিশর থেকে প্রকাশিত।
বিঃ দ্রঃ- আমরা এই ঘটনায় দেখেছি যে ইসলামী মুদ্রা ইমাম বাকের (আ.)-এর সময়ে তাঁর সুব্যবস্থাপনায় তৈরী ও প্রচলন হয়। অন্যান্য কিছু সংখ্যক বইতে এভাবে এসেছে যে, ইমাম আলী (আ.)-এর সময়ে তার নির্দেশে বসরাতে ইসলামী মুদ্রা তৈরী করা হয়। এ বিষয়টির সাথে উল্লিখিত বিষয়ের কোন প্রকার বৈপরীত্য নেই, এ কারণে যে ধরে নেয়া যেতে পারে ইসলামী মুদ্রা তৈরীর কাজ ইমাম আলী (আ.)-এর সময় থেকে শুরু হয়েছে কিন্তু তার পরিপূর্ণতা ইমাম বাকের (আ.)-এর সময়ে। এ বিষয়ে আরো বেশি জানার জন্য মরহুম সারদার কাবুলির ‘গায়াতুত তা’দিল’ বইটির ১৬ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
২৬। জামেয়ুর রোয়াত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯ ।
২৭। জামেয়ুর রোয়াত, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৭, ৩২৪, ৩২৫।
২৮। আশশিয়াতু ওয়াল হাকিমুন, পৃ. ১২৮।
২৯। সাফিনাতুল বিহার, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৯৬।
৩০। মুনতাহাল আমাল, ২য় খণ্ড, পৃঃ - ৭।
৩১। যে ফিকাহ্ শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য লাভ করেছে তাকে ফকীহ্ বলা হয়।
৩২। তোহ্ফাতুল আহবাব, মুহাদ্দিস কোমী, পৃ. ৩৫১।
৩৩। রেজালে কাশি, পৃ. ১৬২।
৩৪। কাফি, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৬৯, বাছায়েরুদ দারাজাত, পৃ. ১৪১, তাওয়ারিখুন নাবী ওয়াল আল, তুসতারি, পৃ. ৪০, আনওয়ারুল বাহিয়াহ্. মুহাদ্দেস কোমী, পৃ. ৬৯।
৩৫। ওয়াসাইলুশ শিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩৩।
৩৬। ওয়াসাইলুশ শিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬।
৩৭ । প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭৪।
৩৮। প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪০।
৩৯। ওয়াসাইলুশ শিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৯।
৪০। প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩১।
৪১। প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৫।
৪২। প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬৯ ।
৪৩। ফুরুয়ে কাফি, পৃ. ৩৪৩ ।
৪৪। ওয়াসাইলুশ শিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৩৩ ।